মাথা ব্যথার কারণ, ধরণ ও প্রকারভেদ

মাথাব্যথা (Headache)

মাথা ব্যথার নির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা দেওয়া কঠিন। বলা হয় এটি এক ধরনের ব্যথা বা ব্যথার অনুভূতি যা মাথা ও মাথার চারিপাশে হতে পারে (In and around the head)। কারো কাছে ব্যথা হতে পারে, কারো কাছে মনে হয় মাথা ধরে আছে, মাথায় অস্বস্তি বা খারাপ লাগছে। মাথা ব্যথা এত সাধারণ যে, বলা হয় যার মাথা নেই তার মাথা ব্যথা নেই। এমন কোন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না যার জীবনে একবার মাথা ব্যথা হয় নি। যেহেতু এটা সব মানুষেরই হয়, তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি গুরুতর কোন রোগ নয়। তবে কিছু রোগ আছে সেগুলো কে কিছু গুরুতর রোগের উপসর্গ বা নির্দেশক বলা হয়ে থাকে। তার মানে অভ্যন্তরীণ কোন রোগের কারণে হতে পারে।

মাথা ব্যথা

মাথা ব্যথার ধরন ও প্রকারভেদঃ

মাথা ব্যথা এমন একটি অসুখ যেটা দেখা যায় না, ধরা যায় না। আবার রোগী বলছেন যে আমার তীব্র মাথা ব্যথা – এটা যে আসলেই এতটা তীব্র এরকম নাও হতে পারে। কারণ, এক একজন মানুষের সহনশীলতা এক এক রকম। তাই মাথা ব্যথার তীব্রতা বুঝতে হলে কিছু জিনিস দেখতে হবে।

যেমন, কর্ম ক্ষমতা কমে যাওয়া – কেউ মাথা ব্যথার জন্য স্কুলে যেতে না পারা, অফিসে যেতে না পারা অথবা কাজে যেতে না পারা অথবা বার বার চিকিৎসক এর কাছে বা হাসপাতালে যেতে হয় এমন। এগুলোকে বলা হয় তীব্র মাথা ব্যথা বা সিভিয়ার হেডেক। আবার কিছু রোগীর মাথা ব্যথা ইনজেকশন দিয়ে কমাতে হয়। তাই মাথা ব্যথা গুলোর প্রকার ভেদ জানা জরুরী। বিশ্ব হেডেক সোসাইটি মাথা ব্যথা কে ২ ভাগে ভাগ করে।

  1. প্রাইমারী হেডেক – এটি বেশীরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়। ২০-৪০ বছর বয়সে এই হেডেক গুলো শুরু হয়। প্রায় ৯০% ক্ষেত্রে মাথাব্যথা গুলো প্রাইমারী হেডেক। এগুলো অত গুরুতর নয়, বার বার হয় এবং সিরিয়াস কোন রোগ নির্দেশ করে না। যেমন মাইগ্রেন, টেনশন টাইপ হেডেক ইত্যাদি। এগুলো পুরোপুরি নির্মূল করা না গেলেও কিছু ওষুধ ও জীবন-যাত্রায় পরিবর্তন এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
  2. সেকেন্ডারি হেডেক – এটি মাথা, ঘাড় বা শরীরের অন্য কোন সিরিয়াস রোগ নির্দেশ করে। মোট মাথা ব্যথার ১০% ক্ষেত্রে এটা দেখা যায়। ১% মাথা ব্যথা ব্রেন টিউমার এর কারণে হয়ে থাকে। তাই সেকেন্ডারি মাথা ব্যথা গুলোর কারণ জানা বিশেষ ভাবে প্রয়োজন।

মাথা ব্যথা নিয়ে কখন আমরা চিকিৎসক এর কাছে যাই?

  1. যখন আমরা দেখি মাথা ব্যথা টা বার বার হচ্ছে এবং দিনে দিনে সংখ্যায় ও স্থায়িত্ব বাড়ছে। আগে যেটা মাসে বা বছরে ১-২ বার হত, এখন সেটা মাসে ২-৩ বার, এমনকি সপ্তাহে ৩-৪ বার হচ্ছে। এগুলোকে বলে ক্রনিক হেডেক।
  2. কিছু আছে নতুন মাথা ব্যথা। এই নতুন মাথা ব্যথা গুলোকে গুরুত্ব সহকারে নিতে হবে। কারণ এগুলো বড় কোন অসুখের কারণেও হতে পারে এবং ফল শ্রুতিতে পরবর্তীতে রোগীর মৃত্যু ও হতে পারে। আবার কিছু নতুন মাথা ব্যথা এমনও হতে পারে, যেগুলো তেমন গুরুতর নয় বা চিকিৎসা না করলেও ক্ষতি হয় না।

 

কখন চিকিৎসক এর কাছে যাবেন?

একটা সমীক্ষায় দেখা যায়, মাথা ব্যথা নিয়ে চিকিৎসক এর কাছে যত রোগী আসে, তার মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ মূলত চিকিৎসার জন্য আসে না। বরং মাথা ব্যথা কেন হচ্ছে সেটা নিয়ে চিন্তিত হয়ে আসেন। তারা জানতে চান, তার মাথা ব্যথাটা কেন হচ্ছে এবং এটা কি গুরুতর কোন রোগের উপসর্গ কিনা! মাত্র এক তৃতীয়াংশ রোগী ই চিকিৎসার জন্য আসেন।

তাই একজন চিকিৎসক এর মূল দায়িত্ব হচ্ছে একজন মাথা ব্যথার রোগী যখন উনি দেখবেন, উনি দেখতে চাইবেন যে, রোগীর মধ্যে খারাপ কোন লক্ষণ উপসর্গ আছে কিনা যার কারণে ভবিষ্যতে রোগীর মৃত্যু হতে পারে, অথবা বড় কোন রোগের মাথাব্যথা হচ্ছে কিনা! একজন চিকিৎসক এর মৌখিক নিশ্চয়তা অনেক ক্ষেত্রে রোগীর কষ্টের মাত্রা অনেক খানি কমিয়ে দিতে পারে।

খারাপ লক্ষণ গুলোর আরেকটা নাম হচ্ছে লাল পতাকা উপসর্গ (Red Flag Sign)

এ ব্যাপারে আমাদের সকলের ধারণা থাকা জরুরি। নীচে লাল পতাকা উপসর্গ গুলো লিপিবদ্ধ করা হলোঃ

  1. যে কোন মাথা ব্যথা ৫০ বছর বয়সে বা তার বেশী বয়সে প্রথম দেখা দেওয়া।
  2. সময়ের সাথে সাথে মাথা ব্যথা বাড়তে থাকা (Progression of headache) এর মানে মাথা ব্যথাটা শুরু হবার পর থেকে দিনে দিনে এটার সংখ্যা ও মাত্রা উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়তে থাকে। যেমন ব্রেন টিউমার (Space occupying lesions) এ এরকম দেখা যায়। যেমন রোগী একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলেন যে তার একটি মাথা ব্যথা হলো যেটা ৫-১০ মিনিট পর চলে গেল। পরবর্তীতে ১-২ মাস পর দেখলেন এটা আধা ঘণ্টা বা এক ঘণ্টা, কখনো বা আরও বেশী সময় ধরে থাকছে। একসময় দেখা গেল সারাদিন ই থাকছে। মাঝে মাঝে বমি হচ্ছে। ব্রেন টিউমার ছাড়াও টিবি মেনিনজাইটিস, সারকোইডোসিস, লিম্ফোমা বা অন্যান্য কর্কট রোগ (Malignant Diseases) বা মেটাস্টেসিস এ এরকম দেখা যায়।
  3. ঝুঁকিপূর্ণ রোগীর (হৃদরোগ, উচ্চ রক্ত চাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল এর মাত্রা, ডায়াবেটিস বা রক্ত নালীর সমস্যা আছে এধরনের) হঠাৎ তীব্র মাথা ব্যথা হলে। এক্ষেত্রে স্ট্রোক, অ্যারাকনয়েড হেমোরেজ ইত্যাদি হতে পারে।
  4. ৪। তীব্র মাথা ব্যথার সাথে জ্বর, গায়ে ফুসকুড়ি (Rash), প্রচণ্ড দুর্বলতা (Fatigue), ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া (Neck stiffness)
  5. মাথা ব্যথার সাথে শরীরের কোন অংশ অবশ হওয়া (Focal neurologic deficit) বা অন্য রকম অনুভূতি হওয়া (Dysasthesia), ঠিক মত কথা বলতে না পারা ( Dysphasia), চোখে ঝাপসা দেখা বা একেবারে না দেখা (Deamness/ Absence of vision) ইত্যাদি।
  6. বিশেষ কিছু রোগীর ক্ষেত্রে নতুন মাথা ব্যথা যাদের ক্যান্সার, এইডস, লাইম ডিজিজ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় আমন অসুখ আছে বা এমন ওষুধ সেবন করে যার কারণে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।
  7. মাথা ব্যথার সাথে আচার-আচরণ, চলা-ফেরা বা কথা-বার্তায় অসংলগ্নতা (Confusion) হতে শুরু করে অজ্ঞান (Coma) হয়ে যাওয়া।
  8. প্রথম বারের মত মাথার একপাশে প্রচণ্ড ব্যথা, যেখানে হাত দিয়ে টেম্পোরাল আর্টারি নামক রক্তনালী বা ব্যথার জায়গাটা ধরা যায় (palpable tenderness), সাথে চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হতে পারে আবার নাও হতে পারে, জ্বর থাকবে, ব্লাড টেস্ট এ ESR>100 এবং রোগীর বয়স ৫০ এর বেশী হলে ধরে নিতে হবে টেম্পোরাল আর্টারি নামক মেডিকেল ইমার্জেন্সী। এটার চিকিৎসা স্টেরয়েড দিয়ে করতে হয়।
  9. ৯। জীবনে প্রথমবারের মত প্রচণ্ড মাথা ব্যথা যেটা সেকেন্ডের মধ্যেই সর্বোচ্চ তীব্রতায় চলে যায়। এটাকে বলে থান্ডারক্ল্যাপ হেডেক (Thunderclap headache)। মস্তিষ্কে থাকা অ্যানিউরিজম থেকে রক্তপাত বা সাব অ্যারাকনয়েড হেমোরেজ এ এটা দেখা যায়।
  10. ৯। যে মাথা ব্যথা ঢোক গিলা কাশির সময় (Valasalva menoeuvre) বা যেকোনো শারীরিক চাপ যেমন কোষ্ঠকাঠিন্য (Exertion) এবং মাথার পজিশন পরিবর্তন এর সাথে সাথে বেড়ে যায়। এটা মস্তিষ্কের ভেতরের চাপ বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ।
  11. ১০। পেপিলো ইডিমা (Papilloedema)। এটা মস্তিষ্কের ভেতরের চাপ বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ।
  12. ১১। মাথায় আঘাতের পর থেকে মাথা ব্যথা।
  13. ১২। কোন মহিলার প্রেগনেন্সি বা প্রেগন্যান্সি পরবর্তী সময় মাথা ব্যাথা। এটা পিটুইটারি বা রক্তনালীর সমস্যা হতে পারে।

 

মাথা ব্যথায় করনীয়

মাথা ব্যথা যেহেতু খুব স্বাভাবিক, তাই বেশীরভাগ মানুষ নিজেই জানে এটাকে কিভাবে চিকিৎসা করতে হয় বা এটাকে কিভাবে সমাধান করা যায়। কিছু লোক জানে যে মাথাটা ভালো করে মেসেজ করে দিলে ভালো হয়, কিছু  লোক জানে যে ঘুমালে এটি চলে যায়, আবার কিছু লোক জানে যে প্যারাসিটামল বা অন্য কোন ওষুধ খেলে এটি কমে যায়। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে মাথা ব্যথার রোগীরা সামাজিক ভাবে জেনে যায় যে তার একটি মাথা ব্যথা হবে এবং এই কাজ করলে বা এই ট্যাবলেট খেলে মাথা ব্যথা কমে যাবে। শুধু আমাদের দেখতে হবে এটা তার স্বাভাবিক কর্মদক্ষতা কমিয়ে দেয় কিনা বা খারাপ কোন অসুখের কারণে হচ্ছে কিনা! এ ব্যাপারে একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক এর পরামর্শ জরুরী।

মাথা ব্যাথা প্রতরোধের উপায়ঃ

১। সঠিক সময় ও নিয়মে ঘুম ও বিশ্রাম নেয়া।

২। নিয়মিত শরীর চর্চা, ফিটনেস ও সুস্থতার দিকে খেয়াল রাখা। দুশ্চিন্তা, অবসাদ ইত্যাদি থেকে দূরে থাকা।

৩। অতিরিক্ত চা, কফি, কোমল পানীয় পান না করা।

৪। মাথা ব্যাথা কমানোয় আপনার পূর্বের  অভিজ্ঞতা কাজে লাগান।

৫। অতিরিক্ত ঠান্ডা না খাওয়া বা ঠান্ডা লাগানো।

৬। দীর্ঘক্ষন একটানা উপবাস না করা বা একটানা একঘেয়ে কাজ না করা।

৭। মাথা ব্যাথা শুরু হওয়ার সাথে সাথেই প্রয়োজনীয় ওসুধ গ্রহন ও নির্দেশনা মেনে চলুন। কারণ ব্যাথা একবার ছড়িয়ে গেলে ব্রেনে কিছু নিউরোট্রান্সমিটার নিঃসৃত হয়, যার কারনে ব্যাথা আর সহজে নিয়ন্ত্রণে আনা যায় না।

৮। একটা ঘুম, বিশ্রাম, মাথায় হালকা মেসেজ অথবা সফট কোন মিউজিক মাথা ব্যাথা কমাতে পারে। যেকোনো টি চেষ্টা করে দেখতে পারেন।

৯। যদি দেখেন আপনি আপনার স্বাভাবিক কর্মদক্ষতা হারিয়ে ফেলছেন, পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেবার পরও বার বার বার হচ্ছে বা উপরে উল্লিখিত কোন লাল পতাকা উপসর্গ (Red flag sign) দৃশ্যমান হচ্ছে, তাহলে একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক এর পরামর্শ নেয়া ভীষন জরুরী।

কি রোগের জন্য কোন ডাক্তার দেখাবেন?

কি রোগের জন্য কোন ডাক্তার দেখাবেন?

প্রথমবারের মতো কোনো রোগের উপসর্গ দেখা গেলে সবার প্রথমে আমরা যেই ব্যাপারটা নিয়ে সবচেয়ে বেশী চিন্তায় পড়ি তা হচ্ছে, কোন …বিস্তারিত

ডেঙ্গু

ডেঙ্গু সতর্কতাঃ কখন হাসপাতালে ভর্তি প্রয়োজন?

অন্যান্য বছরের চেয়ে এ বছর এডিস মশা বাহিত মশার কামড়ে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ দিন দিন বেড়েই চলেছে। এডিস মশার কামড় …বিস্তারিত

এডিনয়েড

শিশুর এডিনয়েড এর কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিকার কি?

শীতকালে সাধারণত শিশু ও কিশোরদের ঠান্ডা-সর্দি জনিত নানা রোগ বাড়তে দেখা যায়। বিশেষ করে নাক, গলা ও কানের সমস্যা বেড়ে …বিস্তারিত

শব্দদূষণ

শব্দদূষণ একটি অদৃশ্য আতংকের নাম।

শব্দদূষণ (Noise Pollution) শব্দদূষণ একটি অদৃশ্য আতংকের নাম। এটা চোখে দেখা যায়না কিন্তু জল-স্থল-অন্তরীক্ষে সব জায়গায় হতে পারে। শব্দ দূষণকে …বিস্তারিত

মাথা ব্যথা

মাথা ব্যথার কারণ, ধরণ ও প্রকারভেদ

মাথাব্যথা (Headache) মাথা ব্যথার নির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা দেওয়া কঠিন। বলা হয় এটি এক ধরনের ব্যথা বা ব্যথার অনুভূতি যা মাথা …বিস্তারিত